জাকাত; ইসলামী অর্থনীতি এবং বাংলাদেশ পর্ব ১

jakat islami orthoniti abong bangladesh cover image by sultanee

Zakat, Islamic Economics and Bangladesh Part 1: একজন মুসলমান হিসেবে এটা আপনার জন্য জানা অতি জরুরী———-

কালো টাকা বা অবৈধ্য সম্পদ শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে ট্র্যক্স না দেয়ার কারনেই নয় বরং যাকাত না দিলেও আপনার সম্পদ অবৈধ্য, অপবিত্র হয়ে যায় অর্থ্যাৎ আপনাকে ট্র্যক্স দেয়ার পাশাপাশি যাকাত ও দিতে হবে।
একটি রাষ্ট্রের সামগ্রীক উন্নয়ন এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমানের অর্থ এবং বাংলাদেশের সকল মুসলিম নাগরিক যদি সঠিকভাবে শুধুমাত্র যাকাত প্রদান করে তাহলে এই দেশে আর কোন গরিব খুজেঁও পাওয়া যাবে না।
আজকের আর্টিকেল এ আমরা যাকাত সংক্রান্ত সকল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আমাদের এই প্রচেষ্ঠা আপনাকে আলোর পথে চলতে সহায়তা করবে।

যাকাত না দেয়ার পরিনাম

শুরুতেই জেনে রাখা ভালো- যে ব্যাক্তি যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করবে সে মুরতাদ বা কাফের হিসেবে গণ্য হবে। পবিত্র কোরআন শরিফে যাকাত না দেয়ার ভয়াবহ পরিনামের বর্ণনা রয়েছে ;

জাকাত; ইসলামী অর্থনীতি এবং বাংলাদেশ https://sultanee.com/zakat-islamic-economy-and-bangladesh/
Surah Tawbah | Ayat 34 and 35

যারা সোনা রূপা জমা করে অথচ আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন, যেদিন তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে, অতঃপর তা দ¦ারা তাদের কপালে, র্পাশ্বদেশে, ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে এবং (বলা হবে) এখন তার স্বাদ গ্রহন কর – যা তোমরা জমা করেছিলে। (সুরা তাওবা, আয়াত ৩৪ ও ৩৫)

যাকাতের সংঙ্গা

যাকাত এর অর্থ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া ও পরিমাণে বেশী হওয়া। সুস্থ ও সুসংঘবদ্ধ হওয়া, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। এই সবকটি অর্থই পবিত্র কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত আছে।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়: শরীয়তের নির্দেশ ও নির্ধারণ অনুযায়ী নিজের মালের/সম্পদের একাংশের স্বত্বাধিকার রাসূলুল্লাহ (সা:) এর বংশধর ব্যতিত কোন অভাবী নিঃস্ব গরীব মুসলমানকে দিয়ে দেয়া এবং তার বিনিময়ে কোন কিছু না নেয়া।

যাকাতের লক্ষ্য

ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার একটা স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। ইসলাম ধর্মের মধ্যে যে সকল ইবাদতের কথা বলা হয় তার মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাতকে কুরআন ও হাদীসে নামাযের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্যই ইসলামী ফিকহবিদগণ যাকাত সংক্রান্ত হুকুম আহকামকে “ইবাদত” অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে ব্যাক্তির মধ্যে লোভ ও লালসার মত কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। যাকাতের বরকতে আল্লাহ তা’আলা যাকাত দাতার সম্পদ বৃদ্ধি করেদেন। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত দাতার উত্তম গুন ও মহান আর্দশ ব্যাক্তি ও সমাজ জীবনে ফুটে উঠে। যাকাত মুলত আমাদের সমাজে গরীব ও মিসকিনদের হক। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে হাক্কুল আবেদ বা বান্দার হক আদায় হয়। সমাজে সুষম অর্থ ব্যবস্থা বিরাজ করে এবং অন্যায় অনাচার বন্ধ হয়ে যাবে।
চিন্তা করে দেখুন যদি আমাদের আশে পাশে বসবাসকারী সবাই যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল থাকে তাহলে অর্থের জন্য যে সকল খারাপ কাজ সংগঠিত হয় তা বন্ধ হয়ে যাবে। যাকতা ইসলাম ধর্মে নামাজের মত সমান গুরুত্ব বহন করে; কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে আমাদের সমাজে নামাজকে মানুষ যেই ভাবে গুরুত্ব দেয় ঠিক ততটাই যাকাতকে অবহেলা করে।

যাকাত কার উপর ওয়াজিব

যাকাতের গুরুত্ব অত্যধিক কিন্তু তা সকলের উপর ডালাওভাবে প্রযোজ্য নয়। অর্থ্যাৎ যাতাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু শর্ত প্রযোজ্য। নিচে বর্ণিত ব্যক্তি ব্যাতিত আর কাউকে যাকাত দিতে হবে না।

  • মুসলমান হওয়া – শুধুমাত্র মুসলমানের উপরই ইসলামী শরিয়ত প্রযোজ্য। অমুসলিম কারো কাছ থেকে যাকাত নেয়া যাবে না বা ভিন্নধর্মালম্বীর উপর যাকাত ওয়াজিব নয়।
  • স্বাধীন হওয়া – কৃতদাস বা গোলামের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়।
  • নিসাবের মালিক হওয়া – পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত বস্তু সমূহের মালিক হতে হবে। যেমন স্বর্ণ, রুপা, উট, গৃহপালিত পশু (গরু / ছাগল) ইত্যাদি
  • এক বছর – উল্লেখিত সম্পদের মালিকানা এক বছর পূর্ন না হলে ঐ সম্পদের উপর যাকাত প্রযোজ্য নয়। অর্থ্যাৎ যে সকল সম্পদ পূর্ন একবছর অতিবাহিত হয়েছে শুধু মাত্র সেই সকল সম্পদের হিসাবে যাকাত ওয়াজিব হবে।
  • প্রাপ্তবয়স্ক – নাবালক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যাক্তির উপর যাকাত ওয়াজিব নয় যদিও বা তার মালিকানায় নিসাব সম সম্পদের এক বছর অতিবাহিত হয়।
  • ঋনমুক্ত হওয়া – ঋনগ্রস্ত ব্যাক্তির উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। এক্ষেতে কোন ব্যাক্তির নিকট কোন সম্পদ থাকলে তা দিয়ে যাকাতের পূর্বে তার সকল ঋন পরিশোধ করা উত্তম।
  • সুস্থমস্তিস্ক বা জ্ঞানসম্মন্ন হওয়া – পাগল বা মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির উপর যাকাত ওয়াজিব নয়।
  • প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া – উৎপাদিত ফসল সহ আরো অনেক ধরনের সম্পদের উপর যাকাত প্রযোজ্য তবে সেই সকল সম্পদ উৎপাদনকারির নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলেই শুধুমাত্র তার উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে।

যাকাত ব্যায়ের খাত সমূহ

আমরা অনেকেই মনে করি যে গরিব মিসকিন কে টাকা বা কোন বস্তু দেয়ার মাধ্যমে যাকাত আদায় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেকেই আবার গৃহকর্মী ও গরিব আত্মীয় স্বজনকে যাকাতের টাকা বা সেই টাকা দিয়ে শাড়ি, কাপড়, লুঙ্গি কিনে দিয়ে থাকে।
শুধুমাত্র গৃহকর্মী বা গরিবদের মাঝে কাপড় লুঙ্গি দিয়ে নয় আরো অনেক ভাবেই যাকাত আদায় করা যায় এবং এই বিষয়ে ইসলামে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও রয়েছে।
তবে বলে রাখা ভালো যে ব্যাক্তির উপর যাকাত ফরজ সে কোনভাবেই অন্য কারো কাছ থেকে যাকাত গ্রহন করতে পারবে না। আমাদের দেশে সকলের অজান্তেই অনেক সময় এমন সব ব্যাক্তিকে আমরা যাকাত দিয়ে থাকি যাদের নিজেদের উপরই যাকাত ফরজ।
উদাহরন স্বরুপ বলা যায় বর্তমান সময়ে (ডিসেম্বর’২১) অনুযায়ী প্রতি ভরি স্বর্ণের মূল্য ৭৩,৪৫৮ টাকা সেই হিসেবে যদি কারো মালিকানায় ৫৫০,৯৩৫ টাকা এক বছরের বেশি সময় যাবৎ থেকে থাকে তার উপরই যাকাত ফরজ। এই হিসেব অনুযায়ী যদি আপনার গৃহকর্মীর ব্যাংকে সময় পরিমান বা তার বেশি অর্থ ডিপোজিট থাকে তাহলে আপনি আপনার গৃহকর্মীকে ও যাকাতের টাকা দিতে পারবেন না। কারন সে আপনার বাসায় কাজ করার মাধ্যমে তার জীবিকা নির্বাহ করছে এবং তার নিজেরে সম্পদের উপরই যাকাত ফরজ হয়ে গেছে যদিও বা আপাতত দৃষ্টিতে তাকে আপনার কাছে গরিব মনে হতে পারে।
যাকাত দানের পূর্বে আমাদের প্রত্যেকেরই ভালো ভাবে জেনে নেয়া দরকার যে কোন কোন খাতে আপনি যাকাত আদায় করতে পারবেন।

উল্লিখিত আয়াতটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে যাকাত ব্যায়ের খাত সর্বমোট আট

  • ফকির: যার সামন্য পরিমান সম্পদ আছে কিন্তু এর মাধ্যমে তার পূর্ণ খাদ্যের ব্যবস্থা হয় না। তাকে ফকির বলে। এই স্বল্প সম্পদ যদি নিসাব পরিমাণের কম হয় তবে তাকে যাকাত দেয়া যাবে।
  • মিসকীন: যার কিছু নেই, একবারে নিঃস্ব তাকে মিসকীন বলে। এদেরকে যাকাত দেয়া যাবে।
  • কর্মচারী: যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। তাকে তার কর্মানুসারে পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দেয়ার বিধান ইসলামী শরীয়ত প্রবর্তন করেছে।
  • ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করন: ভিন্ন ধর্মের মানুষদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যাকাত দেয়া যাবে। এই খাত টি ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে ছিল পরবর্তীতে এটি রহিত হয়ে যায়।
  • দাসমুক্তি: ক্রীতদাসের মুক্তিপণ আদায়ে। অর্থ্যাৎ ক্রীতদাস তার মালিককে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ আদায় করে মুক্তি লাভের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, তার মুক্তিপণের জন্য অর্থ সংগ্রহে যাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে।
  • ঋনমুক্তি: ঋনগ্রস্থ ব্যক্তিকে ঋণ থেকে মুক্তির দেয়ার জন্য যাকাত দিয়ে সহযোগিতা করা যাবে।
  • পথিক: যার বাসস্থানে সম্পদ আছে। কিন্তু যে সাময়িকভাবে রিক্তহস্ত অর্থ্যাৎ তার বাসস্থান থেকে দুরে কোথাও অর্থ সংকট এ পড়েছে এ ধরনের মুসাফির বা ভ্রমনকারীদেরকে সাময়িক উপকারের জন্য যাকাত দেয়া যাবে।
  • আল্লাহর রাস্তায়: যে সকল মুজাহিদ যুদ্ধেও হাতিয়ার সাজ-সরজ্ঞাম ও প্রয়োজনীয় বাহন না থাকার কারণে যুদ্ধে শরীক হতে পারছে না, তাদেরকে যাকাত প্রদান করা যাবে।

আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়তে পারেন আল-কোরআনে অর্থনীতি – ২য় খন্ড; ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

যাকাত সর্ম্পকে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : Zakat, Islamic Economics and Bangladesh Part 2